logo

আদিবাসী শব্দটির সংজ্ঞা কিভাবে নির্ধারিত হয়?

আদিবাসী জনগণকে ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজ এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যদিও আদিবাসীদের জন্য একটি একক, সর্বজনীনভাবে গৃহীত সংজ্ঞা নেই, তবুও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং গবেষকরা আদিবাসী জনগণের পরিচয় নির্ধারণের জন্য কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। নিচে এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

আদিবাসী জনগণের সংজ্ঞার মূল উপাদান

নির্দিষ্ট ভূমির সাথে ঐতিহাসিক সংযোগ:

    আদিবাসী জনগণ সেইসব জনগোষ্ঠী যারা দীর্ঘকাল ধরে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত, যা সাধারণত উপনিবেশ স্থাপন, দখলদারিত্ব, বা আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের আগের সময়কাল পর্যন্ত প্রসারিত। তাদেরকে সাধারণত সেই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

    স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্য:

      আদিবাসী জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, এবং বিশ্বাস ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের বসবাসরত দেশের প্রধান বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা। তাদের এই সংস্কৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এবং এটি তাদের পরিচয়ের মূল উপাদান।

      ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে গভীর সম্পর্ক:

        আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যদের তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে গভীর সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তাদের জীবনধারা, জ্ঞানব্যবস্থা এবং জীবিকা প্রায়শই পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত এবং তারা প্রায়ই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

        স্ব-পরিচয় ও অন্যদের দ্বারা স্বীকৃতি:

        আদিবাসী জনগণ নিজেরাই নিজেদের পৃথক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি দিয়ে থাকে এবং তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় এবং বাইরের সমাজও তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। স্ব-পরিচয় আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

          প্রান্তিককরণ, উপনিবেশ, বা বাস্তুচ্যুতির অভিজ্ঞতা:

            বহু আদিবাসী সম্প্রদায় উপনিবেশ, বাস্তুচ্যুতি, বৈষম্য, এবং প্রান্তিককরণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা তাদের অধিকার, সম্পদ, এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করেছে। এই ইতিহাস তাদের বর্তমান পরিচয় ও অবস্থান গঠনে ভূমিকা রেখেছে।

            সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো:

              আদিবাসী জনগণ সাধারণত তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রাখে, যা সেই দেশের প্রধান কাঠামো থেকে ভিন্ন হতে পারে। এই ব্যবস্থা তাদের ঐতিহ্যগত শাসনব্যবস্থা, সম্প্রদায় সংগঠন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে।

              আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় আদিবাসী জনগণ

              • জাতিসংঘের সংজ্ঞা (UN):
                জাতিসংঘ আদিবাসী জনগণের জন্য কোনো কঠোর সংজ্ঞা দেয়নি কারণ এটি একটি জটিল বিষয়। তবে, জাতিসংঘ স্ব-পরিচয়কে একটি মূল মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং বলেছে যে আদিবাসী জনগণের মধ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
              • উপনিবেশ বা আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের পূর্বের জনগোষ্ঠীর সাথে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা
              • স্বতন্ত্র সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয়
              • প্রান্তিককরণ, দমন, বা উপনিবেশের অভিজ্ঞতা
              • তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি, পরিচয়, এবং জীবনধারা সংরক্ষণ, বিকাশ, এবং হস্তান্তরের প্রয়াস

              • আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) কনভেনশন নং ১৬৯:
                আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আদিবাসী ও উপজাতি জনগণের কনভেনশন, ১৯৮৯ (নং ১৬৯) একটি আইনত বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা আদিবাসী জনগণকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে:
              • যারা সেই অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যেখানে উপনিবেশ স্থাপন বা আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল
              • তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বজায় রাখে, তাদের আইনি অবস্থান যাই হোক না কেন
              • যারা নিজেরাই নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের সম্প্রদায়ও তাদের সেইভাবে স্বীকৃতি দেয়

              • ওয়ার্ল্ড ব্যাংক:
                ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আদিবাসী জনগণকে চিহ্নিত করার জন্য কয়েকটি মানদণ্ড ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে স্ব-পরিচয়, ভূমির সাথে যৌথ সম্পর্ক, ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান, আলাদা ভাষা বা উপভাষা, এবং প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।

              আদিবাসী জনগণের সংজ্ঞা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

              • আইনি স্বীকৃতি:
                এটি তাদের অধিকার, ভূমি, সম্পদ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
              • সংস্কৃতি সংরক্ষণ:
                আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং জ্ঞানব্যবস্থা সংরক্ষণে সহায়তা করে।
              • পরিবেশ সংরক্ষণ:
                আদিবাসী জনগণ জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

              আদিবাসী জনগণ তাদের ভূমির সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুশীলন, স্ব-পরিচয়, এবং প্রায়শই প্রান্তিককরণ বা উপনিবেশের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়। যদিও এককভাবে কোনো কঠোর সংজ্ঞা নেই, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সম্মিলন আদিবাসী জনগণের পরিচয় নির্ধারণে সাহায্য করে এবং তাদের অধিকার, সংস্কৃতি, এবং সংরক্ষণের প্রয়াসে স্বীকৃতি প্রদান করে।

              logo

              © 2017 - 2025 Jumjournal | All rights reserved

              জুমজার্নেলের কোন কন্টেন্টস ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হচ্ছে না। জুমজার্নালের কোন তথ্য বা কন্টেন্ট বিষয়ে অভিযোগ থাকলে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com

              Donate us