বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী ভূমির অধিকার সুরক্ষা একটি জটিল বিষয়, যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্মুখীন ঐতিহাসিক, আইনি, এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান করতে হবে, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম (পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল – CHT) এবং সমতল অঞ্চলে। বাংলাদেশের আইনগত কাঠামোর মধ্যে আদিবাসী জমির অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত করা যেতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ১৯৯৭ এর বাস্তবায়ন
- সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন: ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (CHT Peace Accord) ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, যা পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার স্বীকৃতির উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির অনেক ধারাই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির ভূমি অধিকার, সেনা প্রত্যাহার, এবং জমি বিরোধ নিরসনের জন্য ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠার অংশগুলি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
- ভূমি কমিশনকে শক্তিশালী করা: পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি বিরোধ নিরসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ভূমি কমিশনকে আরও কার্যকর করতে হবে, যাতে এর সিদ্ধান্তগুলি বাধ্যতামূলক হয়। কমিশনকে পর্যাপ্ত তহবিল প্রদান এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
২. প্রথাগত জমির অধিকারের স্বীকৃতি
- আইনি স্বীকৃতি: বাংলাদেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমির মালিকানা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথাগত আইন ও রীতিনীতির অনুসরণ করে। জাতীয় আইনে এই প্রথাগত অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, আইন প্রণয়ন করে আদিবাসী জমির মালিকানাকে ব্যক্তিগত না করে সামষ্টিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
- জাতীয় ভূমি আইন সংশোধন: জাতীয় ভূমি আইনগুলোকে সংশোধন করে এমন বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমির অধিকার স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা দেয়। এর মধ্যে আদিবাসী ভূমি তাদের সম্মতি ব্যতীত বিক্রি বা স্থানান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
৩. ভূমি দখল ও অনুপ্রবেশ থেকে সুরক্ষা প্রদান
- আইন প্রয়োগে শক্তি বৃদ্ধি: সরকারকে অবৈধ জমি দখল ও অনুপ্রবেশ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে ভূমি দখলে জড়িত ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করা অন্তর্ভুক্ত।
- ভূমি ব্যবহার নীতির বাস্তবায়ন: আদিবাসী ভূমি অনুপ্রবেশ, অবৈধ বনাঞ্চল কাটা এবং অবৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে রক্ষা করতে কার্যকর ভূমি ব্যবহার নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।
৪. স্বাধীন, পূর্বানুমতি, এবং অবগত সম্মতির (FPIC) নিশ্চয়তা প্রদান
- বাংলাদেশে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির জন্য অত্যাবশ্যক যে তাদের ভূমি এবং সম্পদ সংক্রান্ত যে কোনো প্রকল্প, উন্নয়ন কার্যক্রম বা সরকারি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীন, পূর্বানুমতি ও অবগত সম্মতি নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তাদের জীবিকা ও ভূমির উপর যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
৫. আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন
- ILO কনভেনশন ১৬৯: বাংলাদেশ এখনও ILO কনভেনশন ১৬৯ অনুমোদন করেনি, তবে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন করা হলে সরকার আদিবাসী জমির অধিকার সুরক্ষার প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শন করবে।
- UNDRIP-এর সাথে সামঞ্জস্য: বাংলাদেশ তার জাতীয় নীতিগুলি জাতিসংঘের আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ক ঘোষণার (UNDRIP) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, যা আদিবাসী জনগণের জমি, অঞ্চল, এবং সম্পদের অধিকারকে গুরুত্ব দেয়।
৬. একটি সমন্বিত ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা
- আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে এমন অঞ্চলে, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতল অঞ্চলে, একটি সম্পূর্ণ ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত। এই নিবন্ধন ব্যবস্থায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের পৈতৃক জমির সঠিকভাবে রেকর্ড রাখা হবে, যা তাদের জমির ওপর আইনগত সুরক্ষা প্রদান করবে।
৭. আইনি সচেতনতা এবং পক্ষে সুরক্ষা প্রচার
- আইনি শিক্ষা: আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করা উচিত, এবং তাদের আইন ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এর মাধ্যমে তারা তাদের জমির অধিকার কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারবে।
- আইনি সহায়তা প্রদান: সরকার এবং এনজিওগুলো আদিবাসী সম্প্রদায়কে আইনগত সহায়তা প্রদান করতে পারে যাতে তারা ভূমি বিরোধে জড়িয়ে পড়লে সহজেই মোকাবিলা করতে পারে এবং আইনি দাবি জানাতে পারে।
৮. স্থানীয় ও জাতীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা
- ভূমি অধিকার এবং সংশ্লিষ্ট নীতিমালার আলোচনায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার। এর মাধ্যমে নীতি নির্ধারণে তাদের স্বার্থগুলি বিবেচিত হবে।
৯. সরকারি সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা
- আদিবাসী ভূমির অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলির সমাধানে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাগুলির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় থাকা জরুরি। আদিবাসী বিষয়ক একটি বিশেষ আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হলে তা নীতি বাস্তবায়ন এবং দ্বন্দ্ব সমাধানে সহায়ক হবে।
১০. সমতল অঞ্চলের আদিবাসী ভূমি অধিকার সুরক্ষা
- যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বিষয়টি বেশি আলোচিত হয়, তবে সমতল অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিও ভূমি অধিকার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সরকারকে এই সম্প্রদায়গুলির প্রথাগত ভূমির অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের জমি দখল প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সারসংক্ষেপে, বাংলাদেশের আদিবাসী ভূমির অধিকার সুরক্ষার জন্য বিদ্যমান চুক্তি যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন, জাতীয় আইন সংশোধন করে প্রথাগত চর্চার স্বীকৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য করা জরুরি। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে আরও নিরাপত্তা, স্বায়ত্তশাসন, এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবিকার সুরক্ষা প্রদান করা সম্ভব হবে।